শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী 

বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে কয়জন সাহিত্যিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মুনীর চৌধুরী। তার আসল নাম আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী।তিনি ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার গোপাইরবাগ গ্রামে।

তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, বাগ্মী এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী।

মুনীর চৌধুরী ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন এবং ১৯৪৩ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স এবং ১৯৪৭ সালে একই বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র।

বক্তৃতা নৈপুণ্যের সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনের প্রথম বছরেই হলের সেরা বক্তা হিসেবে প্রোভোস্ট্স কাপ জেতেন। ১৯৪৬ সালে নিখিল বঙ্গসাহিত্য প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক সংখ্যক পুরস্কার জেতেন। ছাত্রাবস্থাতেই তার লেখা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল।

১৯৪৯ সালে মুনীর চৌধুরী খুলনার ব্রজলাল কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। একই বছর তিনি লিলি মীর্জাকে বিয়ে করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে যোগদেন এবং সেবছর আগস্ট মাসে ইংরেজির অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষকদের প্রতিবাদ সভা আহ্বান করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন ও তাকে চাকরীচ্যুত করা হয়। কারাবন্দী হওয়ার পর প্রায় দুইবছর তিনি দিনাজপুর ও ঢাকা জেলে বন্দী জীবনযাপন করেন।

বন্দী অবস্থায় ১৯৫৩ সালে বামপন্থী রণেশ দাশগুপ্ত জেলখানাতে ২১ ফেব্রুয়ারি উৎযাপনের লক্ষে মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লেখার অনুরোধ জানান। এই অনুরোধের ভিত্তিতে তিনি ‘কবর’ নাটকটি রচনা করেন। এ নাটকটি তার শ্রেষ্ঠ নাটক হিসেবে খ্যাত এবং এর প্রথম মঞ্চায়ন হয় জেলখানার ভেতরে, যাতে কারাবন্দীরাই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

সঙ্গী কারাবন্দী অধ্যাপক অজিত গুহের কাছ থেকে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন, কারাগারে থেকেই ১৯৫৩ সালে বাংলায় এমএ পরীক্ষা দেন ও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

১৯৫৪ সালে পূর্বপাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৫৪ সালে নিরাপত্তা বন্দী থাকা অবস্থায় এমএ শেষ পর্ব পরীক্ষা দিয়ে তিনি কৃতিত্বের সাথে বাংলায় মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ই নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের প্রচেষ্টায় বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং আগস্ট মাসে বাংলা বিভাগে সার্বক্ষণিক চাকুরী লাভ করেন। ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে বাংলার প্রভাষক হিসেবে তার চাকুরী স্থায়ী হয়। ১৯৫৬ সালের শেষ দিকে বৃত্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৫৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে আরও একটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। সে বছর সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালে মুহম্মদ আবদুল হাই অকালে মৃত্যুবরণ করলে তার স্থানে মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই মুনীর চৌধুরী বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন, ফলে তার পরীক্ষার ফলাফল এতে ব্যাহত হয়। বামপন্থী রাজনীতিতে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততার কারণে তাকে সলিমুল্লাহ হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একই কারণে পিতার আর্থিক সাহায্য থেকেও তিনি বঞ্চিত হন। এসময় তিনি ঢাকা বেতার কেন্দ্রের জন্য নাটক লিখে কিছু টাকা পেতেন তা দিয়েই তাকে চলতে হতো। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে প্রথম ছাত্র সভা হয়, তাতে তিনি বক্তৃতা করেন।

মুনীর চৌধুরী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দী হন। বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি তার বিখ্যাত নাটক কবর রচনা করেন (১৯৫৩)। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের যেকোন ধরনের সংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ১৯৬৬ সালে রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচারে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলা বর্ণমালাকে কেরোমান বর্ণমালা দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে সে আন্দোলনের সমর্থনে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব বর্জন করেন।

মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বাংলা টাইপ রাইটারের জন্য উন্নত মানের কী-বোর্ড উদ্ভাবন করেন, যার নাম মুনীর অপটিমা। An Illustrated Brochure on Bengali Typewriter (1965) শীর্ষক পুস্তিকায় তিনি তার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন এবং এই নতুন টাইপ রাইটার নির্মাণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকবার পূর্ব জার্মানিতে যান।

মুনীর চৌধুরী ১৯৫৩ সালে কারাবন্দী অবস্থায় কবর নাটকটি রচনা করেন। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা-সংস্কার কমিটির রিপোর্টের অবৈজ্ঞানিক ও সাম্প্রদায়িক বিষয়বস্তুর তীব্র সমালোচনা করে মুনীর চৌধুরী পূর্ব বঙ্গের ভাষা কমিটির রিপোর্ট আলোচনা প্রসঙ্গে একটি দীর্ঘ ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৫৯ সালের ২৭ এপ্রিল প্রবন্ধটি বাংলা একাডেমিতে পঠিত হয়। তিনি বেশ কিছু মৌলিক ও অনুবাদ নাটক লেখেন। অনেকগুলি প্রবন্ধের সংকলন ও প্রকাশ করেন। মীরমানস (১৯৬৫) প্রবন্ধ সংকলনের জন্য দাউদ পুরস্কার এবং পাক-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে লেখা সাংবাদিকতা সুলভ রচনা-সংকলন রণাঙ্গন (১৯৬৬)-এর জন্য সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধি লাভ করেন।

১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বাংলা বর্ণমালা ও বানান-পদ্ধতির সংস্কার প্রচেষ্টার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে প্রবন্ধ লেখেন এবং পরবর্তীতে এ বিষয়ক বিতর্কে সক্রিয় অংশ নেন।

তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে- রক্তাক্ত প্রান্তর, চিঠি, কবর, দণ্ডকারণ্য, পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য, কেউ কিছু বলতে পারে না, রূপার কৌটা, মুখরা রমণী বশীকরণ, মীর মানস, রণাঙ্গন, তুলনামূলক সমালোচনা, বাংলা গদ্যরীতি প্রভৃতি।

১৯৭১ সালের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুনীর চৌধুরী ফিরে আসার কিছুকাল পরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার কিশোর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে যায়। এ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশে মে-জুন মাসে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে এবং জুলাই মাস থেকে কলা অনুষদের ডীন হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সহযোগী আল-বদর বাহিনী তার বাবার বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 

টাইমস/এমএএইচ/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ফের অসুস্থ ফরিদা পারভীন, রাখা হয়েছে আইসিইউতে Sep 03, 2025
img
আপার মতো জাপাকেও ভারতে পাঠাতে হবে: রাশেদ খান Sep 03, 2025
img
খুলনায় জাতীয় পার্টির অফিসে ফের ভাঙচুর Sep 03, 2025
img
মাতারবাড়ী ও মহেশখালীকে সিঙ্গাপুর-সাংহাইয়ের মতো গড়তে চাই: আশিক চৌধুরী Sep 03, 2025
img
সাদা পাথর লুটপাটের ঘটনায় অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক Sep 03, 2025
img
আমি প্রতিদিনই হুমকি পাচ্ছি : মাসুদ কামাল Sep 03, 2025
img
বিসিবি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না লবী, তামিমকে সমর্থন দেবে বিএনপি Sep 03, 2025
img
শুভশ্রীকে ‘লেডি সুপারস্টার’ বলা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন সহ-অভিনেতা Sep 03, 2025
img
বন্ধুর অভিনয় দেখতে স্বপরিবারে থিয়েটারে মেসি! Sep 03, 2025
img
ট্যাগিং-বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন শিবির প্যানেলের নারী প্রার্থীরা: সিবগাতুল্লাহ Sep 03, 2025
img
চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে কেন নেই নরেন্দ্র মোদি? Sep 03, 2025
img
জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম শীর্ষ অলরাউন্ডার সিকান্দার রাজা Sep 03, 2025
img

ডেঙ্গু পরিস্থিতি

আরো ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৪৪৫ Sep 03, 2025
img
বিএনপি ক্ষমতায় এলে স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়াবে : আমীর খসরু Sep 03, 2025
img
জুলাই বিপ্লবে প্রবাসীদের ভূমিকা নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র Sep 03, 2025
img
বেবিচক চেয়ারম্যানের সঙ্গে পাকিস্তান সিভিল এভিয়েশন মহাপরিচালকের সাক্ষাৎ Sep 03, 2025
img
হার মানিনি, প্রতিটা ভুল আমাকে শিখিয়েছে : শাকিব খান Sep 03, 2025
img

রনির চাঞ্চল্যকর তথ্য

ডামি নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্য, ৬০ কোটি ঘুষ, ১২০ কোটি ঋণ! Sep 03, 2025
img
ভোটারপ্রতি একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ১০ টাকা ব্যয় করতে পারবেন, ইসির প্রস্তাব Sep 03, 2025
img
এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ২৮ হাজার কোটি টাকা লুটের অভিযোগ ইউনিয়ন ব্যাংকের Sep 03, 2025